বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:০১ অপরাহ্ন
সুমন তালুকদার,স্টাফ রিপোর্টার॥ বরিশালের গৌরনদী জ্ঞানভান্ডার খ্যাত গৌরনদী পাবলিক লাইব্রেরীটি রাজনৈতিক কারণে বারবার নাম পরিবর্তন হয়েছে।
বর্তমানে পাবলিক লাইব্রেরী নাম পরিবর্তন করে শহীদ স্মৃতি পাঠাগার নামকরন করা হয়েছে। বিভিন্ন ভাষার দেশী বিদেশী দুর্লভ ২৫ হাজার গ্রন্থের ভান্ডার এই পাঠাগারটি এখন উইপোকা আর ইদুরেরে খাদ্য ও বাসস্থানে পরিনত হয়েছে। চুরি হয়ে গেছে কয়েক হাজার মূল্যবান গ্রন্থ। অনেকে মুল্যবান বই পরতে নিয়ে আর ফেরত দেননি। অযত্নে অবহেলায় প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে ।
বিভিন্ন সূত্রের প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গৌরনদীসহ পার্শবর্তী এলাকার যুবক, ছাত্র শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের জ্ঞান আহরনের জন্য এখানে এসে বই পড়তো।
এক সময় জাকজমকপূর্নভাবে সচল ছিল গৌরনদী পাবলিক লাইব্রেরী। রাজতৈনিক প্রতিহিংসা, অর্থ সংকট ও সংরক্ষণের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের দারপ্রান্তে। শহীদদের স্মৃতিগাথা এ প্রতিষ্ঠানটির এমন দুরাঅবস্থার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকার সচেতন মহল। প্রতিষ্ঠানটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবী জানিয়েছেন সচেতন মহল। ১৯৭৫ সালের ৭ মে বিশিষ্ট রাজনিতিবীদ,সাংবাদিক,আইনজীবী এবং বঙ্গবন্দু সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ,বঙ্গবন্ধুর ছোট ভগ্নিপতি শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাদ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরনে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করেছিলেন। উদ্যেগ ছিল শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরনে স্মৃতিসৌধ নির্মান এবং শহীদ স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে সরকারি গৌরনদী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ,সরকারী গৌরনদী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় মসজিদ ঈদগা ময়দান সম্মুখে প্রায় ১৪ শতাংশ জমির উপর এ প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। এলাকার প্রবীনরা অনেকেই বলেছেন শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত এর চিন্তাধারা ছিল মুক্তিযুেদ্ধ সহীদদের দেশ প্রেমের স্মৃতি ধরে রাখার পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষেয়ের হাত থেকে যুব সমাজকে রক্ষার লক্ষেই শহীদ স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগার নির্মান করেন।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় অবিভক্ত গৌরনদীসহ পার্শবর্তী এলাকার যুবক, ছাত্র, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের জ্ঞান আহরনে পাঠকদের পদচারনায় মুখরিত ছিল গৌরনদী পাবলিক লাইব্রেরী অংঙ্গন এবং লাইব্রেরী চত্বরকে ঘিরেই চলেছে সাংস্কৃতিক চর্চা। এখানে ছিল যেমন বিভিন্ন ভাষার দুর্লভ অনেক গ্রন্থ , ধর্মীয় গ্রন্থ ও ডিকসনারী প্রতিদিনের বাংলা ও ইংরেজি এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা। ছিল পরিচালনা কমিটি ও সহস্রাধিক সাধারন ও আজীবন সদস্য । জাতীয় পাটির আমলে গৌরনদী পাবলিক লাইব্রেরীটি বন্ধ করে সেখানে মার্কেট নির্মান উদ্যোগ নেওয়া হলে পাঠকদের প্রতিরোধের মুখে তা সম্ভব হয়নি। লাইব্রেরীটি থাকলেও আজও শহীদদের জন্য কোন স্মৃতিসৌদ নির্মিত হয়নি। গৌরনদী পাবলিক লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠঅকালীন আজীবন সদস্য ও লাইব্রেরী পরিচালনা কমিটির সাবেক সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক জহুরুল ইসলাম জহির জানান, লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে পদাধিকার বলে ইউএনও সভাপতি ও লাইব্রেরীর সদসদের মধ্য থেকে নির্বাচিত কমিটি লাইব্রেরীটি পরিচালণা করতেন। তবে দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর সরকারী গৌরনদী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষকরাই সম্পদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের সময়ে প্রতিষ্ঠানটি ভালোভাবেই চলছিল কিন্তু বিভিন্ন সরকারের সময়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে লাইব্রেরীটি আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে পাঠাগারটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৯ বছর লাইব্রেরীয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ও স্কুল শিক্ষক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, সরকারী অনুদান হিসেবে জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে বছরে নগদ ৭ হাজার টাকা ৭ হাজার টাকার বই পাওয়া যেত। সদস্যদের চাঁদা ও বিশিষ্টজনের অনুদান দিয়েই লাইব্রেরীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনভাতা দেয়া হত। বেতন না পেলেও ঐতিহ্যবাহি প্রতিষ্ঠানটিকে বাচিয়ে রাখতে কাজ করছিলাম। পরবর্তিতে নানান সমস্যার কারনে আমি ২০০৭ ইং সালে ওখান থেকে চলে আসি ।
গৌরনদীর প্রবিন কবি ও লেখক সিকদার রেজাউল করিম জানান আমার নিজের চোখে দেখেছি এ জ্ঞান ভান্ডারে বাংলা , ইংরেজি, অরবী, ফারসি ভাসার অনেক দুর্লভ গ্রন্থ ছিল । কয়েকজন আজীবন সদস্য ও সাবেক কর্মকর্তারা বলেন, ঐতিহ্যবাহী পাঠাগারটি শুধু পাঠকের আত্নার খোরাকই জোটায়নি তরুণদের সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাচারও একটি প্রতিষ্ঠান ছিল । যা বিলুপ্তির পথে। যে কারনে যুব সমাজে নানান অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গৌরনদীর সার্বিক লক্ষ্যনীয় উন্নয়ন হলেও গৌরনদী পাবলিক লাইব্রেরীর মত ঐতিহ্যবাহি প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে। তারা আরো বলেন, আমাদের শৈশবের সেই স্মৃতিমাখা জ্ঞান ভান্ডারের দুরাবস্থা দেখে অনেক খারাপ লাগে । শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের আজীবন সদস্য (অব:) সরকারী অধ্যাপক মোঃ আবদুল মালেক বলেন, লাইব্রেরীটি এক সময় অনেক প্রানবন্ত ছিল, ছিল অনেক দুর্লভ গ্রন্থ ।
আমাদের অবসার সময়টা ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের একটি মিলন মেলা ছিল লাইব্রেরীতে । আমাদের শিক্ষকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল। যেখানে গেলে বিভিন্ন সংবাদ পত্র ও বিভিন্ন ভাষার গবেষনা মূলক গ্রন্থ । প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্জ্জীবিত করার জন্য আমি মানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর কাছে দাবী জানাচ্ছি ।
গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার মূল্যবোধ সম্পন্ন মানবিক মানুষ গড়ার লক্ষে এলাকার সুশীল সমাজ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সমাজের বিত্তবানরা সকলে যদি এগিয়ে আসেন তাহলে গৌরনদীর জ্ঞানভান্ডার খ্যাত পাবলিক লাইব্রেরী অথবা শহীদ স্মৃতি পাঠাগারকে নতুন করে সংস্কারের মাধ্যামে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে চান।
Leave a Reply